শেষ হলো সাত সপ্তাহের অ্যাশেজ লড়াই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে দাপট দেখিয়ে ৪-০ ব্যবধানে অ্যাশেজ জিতে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেই সাথে আবারও অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারও করলো অসিরা। অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পাশাপাশি এবারের পুরো অ্যাশেজ ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। মাঠ ও মাঠের বাইরের ঘটনায় ভরপুর ছিল এবারের অ্যাশেজ টুর্নামেন্ট।
এবারের অ্যাশেজে দ্বিতীয় টেস্টটি ছিল দিবা-রাত্রির। অ্যাশেজের ইতিহাসে এবারই প্রথম দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো। অ্যাডিলেড ওভালের ঐ টেস্টে ১২০ রানে জিতে সিরিজে ডাবল-লিড নেয় অস্ট্রেলিয়া। এর আগে ব্রিজবেনে সিরিজের প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে জিতেছিল অসিরা।
দল হিসেবে ইংল্যান্ড পুরো সিরিজে খারাপ খেললেও ক্রিকেট ভক্তরা মাঠের বাইরে ছিল সক্রিয়। পুরো সিরিজে পাঁচ ভেন্যুতে ৮ লাখ ৫০ হাজার ইংল্যান্ড সমর্থক প্রবেশ করে। তাদের প্রত্যাশা ছিল ইংলিশরা অন্তত সিরিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবে এবং ট্রফি অক্ষুণ্ন রাখবে।
কিন্তু এবারের অ্যাশেজ শুরুর আগ থেকেই আলোচনা-সমালোচনায় বিদ্ধ হয় ইংল্যান্ড। বেন স্টোকসকে বাদ দিয়ে দল গঠন করে সমালোচনা শুনতে হয় তাদের। গত সেপ্টেম্বরে ব্রিস্টলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালে রাতে একটি পানশালার বাইরে মারামারির ঘটনায় ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) স্টোকসকে নিষিদ্ধ রাখে। তাই অ্যাশেজের স্কোয়াডে সুযোগ পাননি স্টোকস। ফলে স্টোকসকে না নেয়া ইংল্যান্ডের শক্তি কমে যাবার কথাই সকলে বলেন। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটেছে, পুরো সিরিজে স্টোকসকে মিস করে ইংল্যান্ড। শোচনীয় ভাবে সিরিজটি হারতে হয় তাদের।
সিরিজের প্রথম তিন টেস্ট জিতে আগেভাগেবই অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। তাই চতুর্থ টেস্টের আগের সিরিজটি হয়ে পড়ে নিয় মরক্ষার। তবে চতুর্থ টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার উপর প্রথমবারের মত প্রাধান্য বিস্তার করে খেলার সুযোগ পায় ইংল্যান্ড। সাবেক অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুকের দুর্দান্ত ডাবল- সেঞ্চুরি ইংল্যান্ডকে চালকের আসনে বসিয়ে দেয়। আগের তিন টেস্টের ছয় ইনিংসে কুকের স্কোর ছিল এমন- ২,৭, ৩৭,১৬, ৭ ও ১৪। তবে চতুর্থ ম্যাচে অপরাজিত ২৪৪ রান করেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডর গ্লেন টার্নারের ৪৫ বছরের রেকর্ড ভাঙেন কুক। ওপেনার হিসেবে নেমে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস খেলে রেকর্ড গড়েন কুক। ১৯৭২ সালে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওপেনার হিসেবে ২২৩ রানে অপরাজিত ছিলেন টার্নার। আর ১৯৯৭ সালের পর ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় হিসেবে পুরো ইনিংস অপরাজিত থেকে সর্বোচ্চ রান করলেন কুক। সর্বশেষ ইংল্যান্ডের হয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওপেনার হিসেবে ৯৪ রানে অপরাজিত ছিলেন সাবেক অধিনায়ক মাইক আর্থারটন।
কুকের এমন সব রেকর্ডের ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন দেখছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু দুর্ভাগ্য ইংলিশদের। পিচের অস্বাভাবিক আচরণের জন্য ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্র’ই হয়। ম্যাচ শেষে পিচ নিয়ে ক্ষোভও ঝাড়েন ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া দুই অধিনায়কই।
অসি দলপতি স্মিথ বলেছিলেন, ‘পাঁচ দিনেও পিচের কোন পরিবর্তন হয়নি। আমার মনে হয় আমরা যদি আগামী কয়েকদিনও এখানে খেলতে থাকি, তারপরও পিচে কোন পরিবর্তন আসবে না। পেসাররা এই পিচ থেকে সুইং ও বৈচিত্র্যময় বোলিং-এ চেষ্টা করেছে। স্পিনাররাও চেষ্টা করেছে সুবিধা নিতে। কিন্তু কোন পরিকল্পনাই কাজে দেয়নি। এমন পিচে বোলারদের সাফল্য পাওয়া অনেক কঠিন। এমন পিচ টেস্ট খেলার জন্য মোটেও উপযোগী নয়।’
স্মিথের মত একই সুরে কথা বলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জো রুটও। তার মতে, ‘এটি বক্সিং-ডে টেস্ট খেলার যোগ্য নয়। এমন পিচে কোন ফলাফল আশা করা বা ফলাফলের জন্য লড়াই করা বোকামি। আমার মনে হয়, একজন খেলোয়াড় হিসেবে সামনে যা আসবে তাই করা উচিত। আমরাও তাই করেছি। কিন্তু আমরা কাঙ্খিত সাফল্যের দেখা পায়নি। অবশ্যই ভালো পারফরমেন্সের পর আপনি ফলাফল দেখতে চাইবেন। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। এ জন্য পিচই দায়ী।’
শুধুমাত্র দু’দলের অধিনায়করাই নন, মেলবোর্নের পিচকে ‘বাজে’ মন্তব্য করতে বাধ্য হয় ক্রিকেটের প্রধান সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। এরপরই টনক নড়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার। আইসিসি পরামর্শ নিয়ে আরও উন্নত মানের পিচ তৈরি করার আশা ব্যক্ত করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।
চতুর্থ টেস্টের স্মৃতি ভুলে সিরিজের শেষ ম্যাচে জয় পেতে মরিয়া ছিলো ইংল্যান্ড। কিন্তু এখানেও ব্যর্থ হয় তারা। ব্যাটসম্যান-বোলারদের ব্যর্থতায় ইনিংস ও ১২৩ রানে হারের স্বাদ নেয় ইংল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত সিরিজ ৪-০ ব্যবধানে হারে ইংল্যান্ড। তারপরও এই সিরিজ থেকে ইতিবাচক অনেক কিছুই দল অর্জন করেছে বলে জানান ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক জনি বেয়ারস্টো।
তিনি বলেন, ‘এমন পারফরমেন্সে আমরা হতাশ। তবে আমাদের মধ্যে একতা আছে। আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। অ্যাশেজের হতাশা ভুলে ওয়ানডেতে ভালো পারফরমেন্স করতে মুখিয়ে আছে দল।’
এবারের অ্যাশেজে সেরা খেলোয়াড় অস্ট্রেলিয়ার দলপতি স্মিথ। ২টি সেঞ্চুরি ও ১টি ডাবল-সেঞ্চুরির সাথে ২টি হাফ-সেঞ্চুরিতে ৫ ম্যাচের ৭ ইনিংসে সর্বোচ্চ ৬৮৭ রান করেন তিনি। অ্যাশেজের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ রানে ষষ্ঠ স্থানে তিনি। তবে প্রথম তিনটিস্থানেই রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি খেলোয়াড় স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
স্মিথের পরই আছেন তারই সতীর্থ শন মার্শ ও ডেভিড ওয়ার্নার। মার্শ ৪৪৫ ও ওয়ার্নার ৪৪১ রান করেন। রান সংগ্রহে সেরা তিন স্থানে যেখানে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার তিনজন, সেখানে চতুর্থ স্থানে জায়গা হয় ইংল্যান্ডের ডেভিড মালানের। ৫ ম্যাচের ৯ ইনিংসে ৩৮৩ রান করেন মালান।
ব্যাটসম্যানদের মত বোলারদের তালিকাতেও অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য। শীর্ষ চারটি স্থান দখল করে রেখেছেন প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজেলউড ও নাথান লিঁও। চার জনের উইকেট শিকার যথাক্রমে ২৩, ২২, ২১ ও ২১। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের আধিপত্যের পর পঞ্চম স্থানে থাকতে পারেন ইংল্যান্ডের সেরা পেসার জেমস এন্ডারসন। ১৭ উইকেট শিকার করেন তিনি।
তাই ব্যাটিং-বোলিং-এর এমন সব পারফরমেন্সও প্রমাণ করে পুরো সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কতটা উজ্জ্বল ছিল অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা।