‘সময় একটি বড় নিরাময়ক, সময় চলন্ত’- উদ্ধৃতিটি বিশ্ব ক্রিকেটে কোন দলের জন্য মানানসই হলে সেটা অস্ট্রেলিয়া পুরুষ দল।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে সর্বশেষ সিরিজ থেকে দেশের বাইরে পূর্ণাঙ্গ জয়ের ধারায় ফেরে দলটি। স্বাগতিক পাকিস্তানকে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে অসিরা।
এর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া দল এক নাগারে আট ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়ে। এর আগের মাসে ভারত সফরে প্রথম দুই ম্যাচ পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শেষ তিনটি জিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয় বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। ২০০৯ সালের পর ভারতের মাটিতে এটা ছিল অস্ট্রেলিয়া দলের প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়।
ভারতের বিপক্ষে অসি দলের পারফরমেন্স কেবলমাত্র ক্রিকেট বিশ্বকে বিস্মিত করেনি, দীর্ঘ ১৮ মাস ধুকতে থাকার পর দলটির পুনরুজ্জীবি হয়ে ওঠার প্রথম লক্ষণও ফুটে ওঠে।
ভয়ংকর ২০১৮
২০১৮ সালের মার্চ মাসে ফিরে যাওয়া যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বল টেম্পারিং কেলেঙ্কারী ক্রিকেট পাগল অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটা বড় ধাক্কা হয়ে আসে। কেপ টাউন টেস্টে কলঙ্কজনক এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দলটির তৎকালীন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ, সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।
যার কারণে ক্যাঙ্গারুদের মনোবল একদম ভেঙ্গে যায়। এমনকি নিজেদের লড়াকু মানসিকতা পর্যন্ত দেখাতে পারেনি দলটি। পুরো ২০১৮ সালে ১৩ ম্যাচের মধ্যে মাত্র দু’টি ওয়ানডে ম্যাচ জয় করতে সক্ষম হয় পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলটি।
দলটির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিজ মাঠে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে প্রথম তিন ওয়ানডে পরাজিত হতে হয়। যার প্রেক্ষিতে ‘ব্যাটিং ব্যর্থতা এবং পরাজয়ের জন্য লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই’ বলে দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার ডেল স্টেইন পর্যন্ত সান্ত¦না দেন অসিদের। সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়ায় এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নিজ মাঠে ভারতের কাছে ১-২ ব্যবধানে সিরিজ হারে অস্ট্রেলিয়া। এই পরাজয়ের পর বিশ্বকাপ শিরোপা অক্ষুন্ন রাখার আগে মুক্তি পেতে তাদের হাতে ছিল মাত্র দশটি ওযানডে।
অদম্য মুক্তি
ভারত সফরে প্রথমবারের মত সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে পেতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। উসমান খাজা ও অধিনায়ক এ্যারন ফিঞ্চ দলকে যথার্থ ওপেনিং পার্টনারশীপ এনে দিতে শুরু করেন। ভারতে তিন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে চার ম্যাচে তাদের ওপেনিং জুটি অর্ধ শতক ছাড়িয়ে যায়। যার মধ্যে তিন ম্যাচেই তাদের ওপেনিং জুটি শত রান ছাড়িয়ে যায়।
দুই সিরিজেই পারফরমেন্সের ধারাবাহিকতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দলে নিজের জায়গা পোক্ত করতে সক্ষম হন খাজা। ভারতে পাঁচ ইনিংসে দুটি করে হাফ সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরিতে মোট ৩৮৩ রান করে ‘সিরিজ সেরা’ খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষেও তিনি একই ফর্ম অব্যাহত রাখেন। শেষ ওয়ানডেতে ৯৮ বলে ১১১ রান সহ তিনটি হাফ সেঞ্চুরি করেন খাজা।
ভারতের বিপক্ষে সিরিজে ফর্ম ফিরে পেতে কিছুটা ধুকেছেন ফিঞ্চ। তবে তবে পাকিস্তান সিরিজে ছিলেন তুঙ্গে। প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ১৫৩ রানসহ দুটি সেঞ্চুরি করেন তিনি। অল্পের জন্য তৃতীয় ম্যাচে শত রান থেকে বঞ্চিত হন তিনি। ১১২ দশমিক ৭৫ গড়ে মোট ৪৫১ রান করে ‘সিরিজ সেরা খেলোয়াড়’ নির্বাচিত হন এ তারকা ওপেনার।
রান পেয়েছেন গ্লে ম্যাক্সওয়েলও। স্ট্রাইক রেট ছিল অবিশ্বাস্য। সংযুক্ত আরব আমিরাতে তার স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ১৪০। পাকিস্তানী বোলারদের বেধড়ক শায়েস্তা করে তিন ম্যাচেই করেছেন হাফ সেঞ্চুরি।
ভারত সিরিজে সাড়া জাগানো আরেক ব্যাটসম্যান ছিলেন পিটার হ্যান্ডসকম্ব। জয়ের জন্য ৩৫৮ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করে চন্ডিগড়ে চতুর্থ ওয়ানডেতে ১১৭ রানের ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে পঞ্চম ম্যাচে তিনি বরেন ৫২ রান।
প্রয়োজনের সময় মিডল অর্ডারে রান পেয়েছেন শন মার্শ, মার্কাস স্টয়নিস, এ্যাস্টন টার্নার এবং এ্যালেক্স ক্যারি। এশিয়ান কন্ডিশনে স্পিন এবং পেস উভয় বোলিংয়ের বিপক্ষেই খুবই ভাল করার প্রমাণ দিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা।
স্পিন মাত্রা
ব্যাটিং লাইনআপের ন্যায় অস্ট্রেলিয়া বোলিং বিভাগও বিশেষ করে পেস বিভাগ দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়েছে। ইনজুরির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজেলউড ওয়ানডে সিরিজ মিস করলেও নবাগত ঝাই রিচার্ডসন, জেসন বেহরেনডর্ফ এবং নাথান কালাটার-নাইল প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের নাকানি-চুবানি খাওয়াতে খুব ভাল সহায়তি দিয়েছেন প্যাট কামিন্সকে।
তবে যাইহোক এশিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়া দলের সাফল্যের অন্যতম চাবি-কাঠি ছিল তাদের স্পিন বোলিং বিভাগ। বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকেই সংক্ষিপ্ত ভার্সনে তাদের স্পিন বোলিং ইউনিটকে বেশ ধুকতে হচ্ছে। বহু বিকল্প নিয়ে চেষ্টা করা হলেও কেউই দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারেনি।
তবে ভারত-পাকিস্তান উভয় সিরিজেই এবার এডাম জাম্পা নিজের ভিন্নতা ও গুগলি দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের সমস্যায় ফেরতে সক্ষম হয়েছেন। সমস্যার সমাধানে কিছুটা কার্যকর মনে হয়েছে।
রান কিছুটা বেশি দিলেও দুই সিরিজে ১০ ম্যাচে তিনি ১৮ উইকেট শিকার করেছেন।
এশিয়ার স্পিন সহায়ক কন্ডিশনে টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার সেরা বোলার নাথা লিঁয়ও ছিলেন কার্যকর। এক প্রান্তে টাইট বোলিং করে জাম্পাকে যথার্থ সহায়তা দিয়েছেন তিনি। পাঁচ-এর কম ইকোনোমি রেটে আট ম্যাচ ৮ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।
তারকাদের ফেরা
স্মিথ ও ওয়ার্নারের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ গত মাসে শেষ হয়েছে এবং তাদের ফেরা নিঃসন্দেহে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপকে আরো শক্তিশালী করবে। এছাড় চলমান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে(আইপিএল) দারুন ফর্মে আছেন ওয়ার্নার। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী পাঁচ জনের মধ্যে আছেন তিনি। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলা স্মিথও ফর্মে ফিরছেন।
এ ছাড়া পেসার স্টার্ক ও হ্যাজেলউড বিশ্বকাপ দলে ফিরলে ‘অনেক সমস্যা’ সমাধান হয়ে যেতে পারে অস্ট্রেলিয়ার। এখন দলটির দরকার কেবলমাত্র এ সব তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয়।
তবে কোনও দলের জন্য এটা সব সময় একটা ভাল সমস্যা এবং বিশ্বকাপে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার জন্য খুব কঠিন হবেনা। মাত্র কয়েকমাস আগে যাদের শুরু করা নিয়েই সন্দেহ ছিল টুর্নামেন্টের ছয় সপ্তাহ আগে সেই অস্ট্রেলিয়াই এখন ফেবারিট।