‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক হওয়া যায়’ -বহুল পরিচিত এ পংক্তির সাথে তাল মিলিয়ে হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা গাওয়া শুরু করতে পারেন ‘কতোবার ফাইনালে হারলে এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়’। তবে সবকিছু শেষে এবার কি টাইগার ভক্তদের মুখে হাসি ফোঁটাবে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
এশিয়া কাপের গত চার টুর্নামেন্টের তিনবারের রানার-আপ হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘশ্বাসই বলা যায়। যদিও ফাইনালে ওঠার উপর ভিত্তি করলে শেষ দশ বছরের এশিয়া কাপের সেরা টিমের তালিকা করা হলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো পরাশক্তিদের পিছনে ফেলে এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
২০১২ থেকে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি আসরের মধ্যে সর্বোচ্চ তিনবার ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারত ও পাকিস্তান দুইবার করে এবং শ্রীলঙ্কা একবার ফাইনালে ওঠার গৌরব অর্জন করেছে। তবে তিনবার ফাইনালে উঠেও একবারের জন্যও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি উচিয়ে ধরতে পারেননি টাইগাররা, সেরাদের হাসিটা হাসা হয়নি! অপরদিকে, বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে চার আসরে ভারত দুইবার এবং পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা একবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
চার বছর পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে আবারও শুরু হচ্ছে ক্রিকেটের এশিয়ানদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। আইসিসির ইভেন্টের পর বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এ টুর্নামেন্টের এবার ফরম্যাট টি-টোয়েন্টি। চলতি বছর অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এশিয়া কাপের ফরম্যাটেও এবার টি-টোয়েন্টি।
২০২০ সালে এশিয়া কাপটি শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় কথা ছিল। সে বছর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের জন্য তা আসরটি স্থগিত হয়ে যায়। এবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় নিজ দেশে টুর্নামেন্টটি আয়োজনে অপরাগতা প্রকাশ করে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড। এরপরই আসরটি আরব আমিরাতে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে টুর্নামেন্টটি আরব দেশে অনুষ্ঠিত হলেও স্বাগতিক হিসেবে শ্রীলঙ্কাই থাকছে।
১৯৮৪ সাল থেকে মোট ১৪বার এশিয়া কাপ আয়োজিত হলেও ২০১৬ ব্যতীত প্রতিবারই ছিল ওয়ানডে ফরম্যাটে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ফাইনালে বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। এছাড়া সর্বশেষ ২০১৮ সালে আরব আমিরাতে ওডিআই ফরম্যাটেও বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে টানা চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।
২০১২ সালে এশিয়া কাপ দিয়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিন পরিবর্তনের শুরু হয়। সেবার শচীন-ধোনি-বিরাটের ভারত ও মাহেলা-সাঙ্গাকারা-দিলশান-মালিঙ্গার শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পারলেও মিসবাহ-আফ্রিদির পাকিস্তানে আটকে যায় বাংলাদেশ। গ্রুপ এবং ফাইনাল, দুই পর্বেই পাকিস্তানকে হারানোর খুব কাছে গিয়েও হতাশ হয়েছে টাইগাররা।
ফাইনালে শেষ দুই ওভার শাহাদাৎ হোসেন আরেকটু ভালো বল করতে পারলে কিংবা নাজিমুদ্দিন ব্যাটিংয়ের শুরুতে আর পাঁচ-দশটা রান বেশি করতে পারতেন তাহলে হয়তো দুই রানে হারের বেদনায় ডুবতে হতো না টিম টাইগারদের। ২০১২ ফাইনালের সন্ধ্যায় তামিমের চার আঙুল উঁচিয়ে উদযাপন যেমন অনেক নুয়ে পড়া তরুণকে অদম্য সাহসের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় ঠিক তেমনি ওই ফাইনাল শেষে সাকিব-বিজয়-নাসিরদের কান্নার ছবি দেখে এদেশের যুবক-তরুণরা বুক ভাসান।
২০১৪ এশিয়া কাপে সবকটা ম্যাচ হেরে গ্রুপপর্বেই বিদায় নেয় বাংলাদেশ। ২০১৬ তে নতুন ফরম্যাটে এশিয়া কাপ, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিনতম সংস্করণ টি-টোয়েন্টি। সবাই যখন নিরাশায় ভুগছে ক্যাপ্টেন মাশরাফির অনন্য অধিনায়কত্বে সাথে টিম পারফরম্যান্সে টাইগাররা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে। কিন্তু বিধিবাম! এবারও ফাইনালে ভারতের কাছে ৮ উইকেটের পরাজয়ে কান্নার স্রোতে ভাসে টাইগাররা।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ ফরম্যাট
সর্বশেষ ২০১৮ সালে মরুর বুকে এশিয়া কাপ, ওয়ানডে ফরম্যাটে। ততোদিনে বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী দল। গ্রুপপর্বে দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের সাথে হেরে হোঁচট খেলেও প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারানোয় কোনোমতে সুপার ফোরে জায়গা করে নেয়। সুপারফোরে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে আফগানিস্তান-পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। ফাইনালে আবারও সেই ভারত গেরোয় আটকে হতাশায় বৃত্তে বন্দি হয় টাইগারার।
সময়ের বদলে আবারও এশিয়া কাপের নতুন আসর হাজির। সেই সাথে হাজির বাংলাদেশ দলের হাজারও রকমের সমস্যা। তামিম ইকবাল নেই (টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর)। ইনজুরির কারণে দলে নেই লিটন দাস, ফলে বাধ্য হয়ে মাত্র দু’জন ওপেনার নিয়ে দল ঘোষণা। এর আগে জিম্বাবুয়ে সফরের ভয়াবহ খারাপ পারফরম্যান্স, সাথে চোট জটিলতা।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আকাশে এখন অনেকটা দুর্যোগের ঘনঘটা। তবে দীর্ঘদিন পর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে নেতৃত্বে ফিরেছেন সাকিব আল হাসান। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে সরিয়ে এশিয়া কাপ থেকে বিশ্বকাপ পর্যন্ত সাকিবের কাঁধে নেতৃত্বভার তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
এশিয়া কাপ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী সাকিব, খুশি বিসিবি সভাপতি
এবারও কি ২০১৪ সালের ভয়ঙ্কর পুনরাবৃত্তি হবে? নাকি বাকি তিন ফাইনালের দুঃখ ভুলিয়ে শিরোপা আনবে বাংলার মাটিতে? এতকিছুর মাঝে আরও একটা কথা আশার যোগান দেয়, বাংলাদেশ টিমের সিনিয়র প্লেয়ারদের মতে, ‘টাইগারদের নিয়ে যখনই প্রত্যাশা কম থাকে ওই সময়েই টিম টাইগাররা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে।’ এবার কি তাহলে বাংলাদেশ দলের উপর ভক্তদের পত্যাশা কমেছে?
সে যাই হোক, দেশের আপামর ক্রিকেট সমর্থকদের মনে জমে থাকে আবেগের কৌটা নিয়ে চারকোনা বোকাবাক্সের সামনে বসবে নিজেদের প্রিয়, একান্তই আপন টাইগারদের খেলা দেখতে। তাদের মনের কোনে আশার পালে হাওয়া দিয়ে উঠবে হয়তো এ ভাবনাগুলোই যে-
‘সুপার সাকিব আবারও জ্বলে উঠবেন ব্যাটে-বলে, নিজের ক্রিকেটীয় মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বিপক্ষ দলকে গোপন কোনো ফাঁদে ফেলবেন। ওপেনিংয়ে বিজয়ের ব্যাটে রানের ফুলঝুরিতে পথ দেখা শুরু হবে টাইগারদের, মিডল অর্ডারে সাব্বির রহমান ফিনিক্স পাখির ন্যায় জেগে উঠবেন, একসাথে দলের হাল ধরে বড়ভাই সুলভ পথ দেখাবেন নতুনদের মুশফিক-রিয়াদ, মোস্তাফিজ-হাসান মাহমুদের কাটার-গতির ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে যাবে প্রতিপক্ষের উইকেট, নাসুম-মাহাদী-মিরাজের স্পিন বিষে নীল হবে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা। আবারও জয়ের উল্লাসে মাতবে বাংলা।”
লেখক: মো. মোবারক ইসলাম, চট্টগ্রাম।
স্পোর্টসমেইল২৪/আরএস