প্রথমবারের মতো নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। কেমন কাটলো বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ মিশন? খালি চোখে দেখলে মনে হবে ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি ছিল টাইগ্রেসরা। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে ‘সফল’ একটি বিশ্বকাপ মিশনই করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। প্রাপ্তির খাতা পূর্ণ হলেও আক্ষেপের বেশ কয়েকটি জায়গা তৈরি করেছিল নিগার সুলতানা বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ওই আক্ষেপগুলো না থাকলে হয়তো নিজেদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু পেত বাংলাদেশের মেয়েরা।
বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব শেষে বাংলাদেশের মেয়েদের অবস্থান শেষ থেকে দুই নম্বরে। বাংলাদেশের পিছনে একমাত্রে দেশ হিসেবে অবস্থান করছে পাকিস্তান। এই পয়েন্ট টেবিল দেখে কোনো ভাবেই বাংলাদেশের দারুণ পারফর্মেন্সকে বিচার করা যাবে না। বরং, এই পয়েন্ট টেবিল দেখে বিচার করলে বাংলাদেশের পারফর্মেন্সকে ছোট করে দেখা হবে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মেয়েদের সবচেয়ে শক্তির জায়গা ছিল নিজেদের বোলিং। বিশেষ করে স্পিনাররা ছিলেন তাদের সেরা ছন্দে। বোলাররা তাদের কাজ ঠিকমত করতে পারায় এবারের আসরে বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো দলই ২৫০ রানের কোটা স্পর্শ করতে পারেনি। তবে ব্যাটারদের পারফর্মেন্স আরেকটু ভালো হলে হয়তো এক ম্যাচ নয় জয় আসতে পারতো তিন ম্যাচে। হতে পারতো প্রত্যাশার চেয়েও ভালো পারফর্মেন্স।
শেষমেষ প্রত্যাশামাফিক পারফর্ম করতে পারায় বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ মিশনকে ব্যর্থ বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং বলা যায়, দারুণ এক বিশ্বকাপ মিশন করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। যেখানে দুই ম্যাচে স্পষ্টতই জয়ে সুযোগ হাতছাড়া করেছে টাইগ্রেসরা।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিজেদের বোলিং তোপে ফেলে মাত্র ২০৭ রানেই অলআউট করে টাইগ্রেসরা। হয়তো ম্যাচটা বাংলাদেশের হাতের মুঠোয় আসতে পারতো। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের বিপক্ষে সাবলীল ব্যাটিং করতে না পারার কারণে লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ বাংলাদেশের নারীরা।
লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের বোলিংয়ের প্রশংসা করতেই হবে। ওই ম্যাচে টাইগ্রেস বোলাররা দেখিয়েছিল নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ। আর পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই সেই ধারবাহিকতা ধরে রেখেছিল তারা।
দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড। বৃষ্টিবিঘ্নিত এই ম্যাচে স্বাগতিকদের বিপক্ষে কোনো ধরনের প্রতিরোধই গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। পুরো টুর্নামেন্টে শুধুমাত্র এই ম্যাচেই চমকহীন ছিল নিগার সুলতানা বাহিনী।
বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। এই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৯ রানে হারিয়েছে টাইগ্রেসরা। ছেলেদের মতো মেয়েরাও বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে প্রথম জয়ের দেখা পায়। আর ছেলেদের মতো মেয়েদেরও প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান।
বিশ্বকাপের আগেই পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। বিশ্বকাপের আগে সর্বশেষ কয়েকবারের দেখায় পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পক্ষেই উড়েছিল বিজয় নিশান। এই কারণে পাকিস্তানকে হারাতে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল বাংলাদেশ। আর মাঠেও রেখেছে সেই আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ।
পাকিস্তানের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বধেও বেশ এগিয়ে গিয়েছিল নিগার সুলাতানারা। শেষ ওভারে নিজেদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় সেই জয় পেতেও গিয়েও হাতছাড়া করেছে। জয় না পেলেও বাংলাদেশের বোলিং কতটা শক্তিশালী তা বিশ্বকে দেখিয়েছে মেয়েরা। আর এতেই তৈরি হয় বাংলাদেশের মেয়েদের আক্ষেপ। এই ম্যাচের পরেই অধিনায়ক নিগার সুলতানা জানিয়েছিলেন, ক্লোজ ম্যাচ জিততে আরও বেশি খেলার সুযোগ চান। হয়তো পরের বিশ্বকাপে তীরে এসে ডোবাবে না বাংলাদেশ।
প্রথম চার ম্যাচে এক জয় আর দুই আক্ষেপে পোড়া বাংলাদেশের পঞ্চম ম্যাচের প্রতিপক্ষ ভারত। ছেলেদের ক্রিকেটে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই থাকে অন্য রকম উত্তেজনা। মেয়েদের ক্রিকেটে এই উত্তেজনা না ছড়ালেও ভারতের বিপক্ষে দারুণ এক সুখস্মৃতি নিয়ে মাঠে নেমেছিল জাহানারা-সালমারা।
বাংলাদেশকে ক্রিকেটে প্রথম শিরোপা এনে দেওয়া নারী ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপ জিতেছিল এই ভারতকে হারিয়েই। বিশ্বকাপের মঞ্চে এসে ভারতের বিপক্ষে পেরে উঠেনি বাংলাদেশ। তাদের কাছে হেরেছিল ১১০ রানের বিশাল ব্যবধানে।
ষষ্ঠ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যাট হাতে বড় স্কোর করতে পারেনি বাংলাদেশ দল। ম্যাচও হেরেছে। তবে বল হাতে তাদের হাটু কাপিয়ে দেওয়ার সাহসটা দেখিয়েছিল। বাংলাদেশের স্পিন ভেলকিতে ৪১ রানে চার উইকেট হারিয়ে বসেছিল অজি নারীরা। ওই সময় অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষেই আসবে ফলাফল। তবে শেষ পর্যন্ত আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরাই জিতে নিয়েছিল ম্যাচ।
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম আসরের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। এ ম্যাচেও ইংলিশ নারীদের স্পিন ভেলকি দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে ব্যাট হাতে ব্যাটাররা ব্যর্থতার মিছিলে যোগ দেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে উঠেনি।
বাংলাদেশের বোলিং লাইন আপ বিশ্বের যেকোনো ব্যাটারদের পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারে তা প্রমাণ করেছে মেয়েরা। ব্যাটাররাও করেছেন পারফর্মেন্স। নিয়মিত পারফর্ম করতে না পারার ব্যর্থতায় ভুগেছে তারা। তবুও ফারজানা হক,শারমিন আক্তার আর শামীমা সুলতানারা যা করেছেন সেটা নিসন্দেহেই বলে দেয় আরেকটু সুযোগ সুবিধা পেলে বিশ্বকাপ মঞ্চে আরও ভালো করতে পারবে টাইগ্রেসরা।
আর অধিনায়ক নিগার সুলতানা ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সে মোটামুটি মানের থাকলেও তার বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব দলকে করেছে অনেক বেশি উজ্জ্বল। হয়তো সুযোগ পেলে আবারও প্রমাণ করবেন, বিশ্বকাপে ভালো করার দাবিদার বাংলাদেশের নারীরাও।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর