যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশ স্বাধীনের বহু আগেই বিদেশের মাটিতে দেশের জাতীয় সংগীতের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত অর্জন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে কাজ করেন ৩৪ জন খেলোয়াড়, সঙ্গে ম্যানেজার এবং কোচসহ মোট ৩৬ জন। ওই টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন লুৎফর রহমান।
মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের অহংকার যশোরের লুৎফর রহমান প্রায় ৬ মাস যাবৎ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় বিছানায় পড়ে রয়েছে। তার এ মুমূর্ষু অবস্থাতে দেখার কেউ নেই!
যে মানুষটি এ জাতিকে এনে দিয়েছে একটি স্বাধীন মানচিত্র, তার এ অন্তিম সময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়নি সরকার। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে এ বীর বঞ্চিত হচ্ছেন সুচিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার থেকে। গত মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকেলে যশোর লোন অফিস পাড়া তার নিজ বাসভবনে গিয়ে লুৎফর রহমানের সাথে কথা বলে জানা যায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল এবং তার ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের নানা তথ্য।
১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণকারী লুৎফর রহমান ছোটবেলা থেকে ফুটবল এবং হকি খেলায় আগ্রহী এবং পারদর্শী ছিলেন। যশোর জেলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন তিনি স্কুলের এক খেলায় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পান। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত যশোর জেলা ফুটবল দলের হয়ে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৬৮তে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ড দলের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মিলিত বোর্ডের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন।
১৯৬৯ সালে ঢাকা ওয়ারী ক্লাবে যোগ দেন এবং ১৯৭০ এ দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে রাশিয়ার মিনস্ক ডায়নামো ফুটবল দলের বিরুদ্ধে খেলায় অংশগ্রহণ করেন।
এর আগে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ডামাডোলে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের সিংহভাগ নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি শক্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছিল ঠিক তখনই খেলার মাঠের এ নায়ক বেছে নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক ফন্সন্ট, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন এক অনন্য সাধারণ নজিরবিহীন অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা।
যুগে যুগে দেশে ব্যতিক্রমধর্মী ভূমিকায় দিয়েছে নবতর আঙিক, নবতর সংযোজন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টিসহ খেলোয়াড়দের ডাক দিয়ে সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন তরুণ আলী ইমাম, প্রতাপ, প্যাটেল, জাকারিয়া পিন্টু, আশরাফ এবং মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমানসহ আরও অনেকে। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে ভারতীয় মুদ্রায় ৩ লাখ টাকা তুলে তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কাছে দিয়েছিলাম। ১৬টি খেলার মধ্যে ১২টি খেলায় আমরা জয়লাভ করি এবং বাকি ৪টির ৩টিতে পরাজয়, ১টি ড্র হয়।’
বাংলার এ বীর বলেন, ‘আমাদের সব থেকে গৌরবময় খেলাটি ছিল ২৪ জুলাই ভারতের কৃষ্ণনগরে নদীয়া স্টেডিয়ামে। ঐ দিন ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম খেলা। খেলোয়াড়রা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করবো। এরপর মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সাথে সাথে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবো। বিষয়টি নদীয়া ক্রীড়া সমিতিকে যথাসময়ে অবহিত করা হয়।
‘এই খেলাকে উপলক্ষ্য করে নদীয়ার ক্ষৃষ্ণনগরে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের পোস্টার শহরের উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহে শোভিত হয়। নানা মাধ্যমে শহর জুড়ে ব্যাপক প্রচার চলে। স্বাধীন বাংলা বেতার মারফত খেলার বিষয়ে অবহিত হয়ে কুষ্টিয়া জেলা থেকে উৎসাহী ক্রীড়ামোদীরা বিপুল সংখ্যায় মাঠে সমবেত হন। কিন্তু বিভ্রাট বাঁধলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন নিয়ে। ভারতের সরকার তখন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। বিভ্রান্তির মধ্যেই খেলার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেল। নদীয়া জেলা একাদশ মাঠে উপস্থিত। কিন্তু পতাকা ও জাতীয় সংগীতের বিষয়ে নিষ্পত্তি ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দল মাঠে নামবে না কিছুতেই। অবশেষে নদীয়ার জেলা প্রশাসক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানোর বিষয়ে সম্মত হন।’
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় কাউসার আলী বলেন, শ্রদ্ধেয় লুৎফর ভাইয়ের বাড়িতে এসে অত্যন্ত বেদনার্ত, মর্মাহত এবং লজ্জিত হলাম। দেখলাম জাতি তথা আমাদের যশোরের গর্ব ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ এবং জাতীয় ফুটবল খেলোয়াড় লুৎফর ভাই গত ৬ মাস যাবৎ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায় শায়িত। তার এ অসুস্থতার সাথে শরীরের মধ্যে যুক্ত হয়েছিল আরও এক মরণব্যাধী ডায়াবেটিস।
তিনি আরও বলেন, ব্রেন স্টোকের ঔষধের সাথে সাথে প্রতিদিন ৩বার ইনসুলিন নিয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টায় ৬৮ বছর বয়সে লুৎফর ভাইয়ের প্রতিটি ক্ষণ। কী বিচিত্র আমাদের সমাজ আর দুর্ভাগ্য লুৎফর ভাইয়ের। এ বেদনার খবর তার পরিবার ছাড়া যশোর তথা দেশের কেউ রাখেনি। দুর্ভাগা চিত্রটা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে যখন জানলাম, মাস্টারস পাস করা একমাত্র মেয়ে ফারহানা শারীরিক ও মানসিক অসুস্থ হয়ে মা-বাবার কাছেই আশ্রিত। একমাত্র পুত্র তানভির বেকার। গত কয়েক বছর থেকে লুৎফর ভাইয়ের একমাত্র আয়ের উৎস ব্যবসাও গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে।
এ বিষয়ে যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবির বলেন, লুৎফর রহমান দেশ তথা আমাদের যশোরের গর্বিত সন্তান। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পক্ষে অংশ নিয়ে বিশ্বের দরবারে ক্রীড়ার মাধ্যমে দেশকে মহান স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, আমি তার অসুস্থতার খবর শোনা মাত্রই তার খোঁজ-খবর নিয়েছি, তার সাহায্যে এগিয়ে আসা আমাদের কর্তব্য। সরকার ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একটু সহযোগিতা করলেই সুস্থ্য হয়ে উঠবেন এ প্রবীণ খেলোয়াড়।
মো. জামাল হোসেন, বেনাপোল, যশোর