‘একটি বল একটি গ্রাম ফুটবলের নগরী কুড়িগ্রাম’

জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: ১০:০৬ পিএম, ০৭ এপ্রিল ২০১৯
‘একটি বল একটি গ্রাম ফুটবলের নগরী কুড়িগ্রাম’

ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমাজের বঞ্চিত ও ঝড়ে পড়া শিশু-কিশোরদের নিয়ে গড়ে ওঠেছে কুড়িগ্রাম ফুটবল প্রশিক্ষণ স্কুল। যে স্কুলের মাধ্যমে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিশুরা ফিরেছেন লেখাপড়ায় এবং অস্বচ্ছল পরিবারগুলোকেও করা হচ্ছে আর্থিক সহযোগিতা।

ফুটবলার তৈরি করে দেশের বিভিন্ন ক্লাবে খেলোয়াড় পাঠিয়ে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সমাজে শিশুশ্রম বন্ধ, মাদক মুক্ত সমাজ, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মুক্ত করতে ঝড়ে পড়া শিশুদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনা এবং দেশের ফুটবলে ভালো মানের খেলোয়াড় তৈরির লক্ষ্যে ‘একটি বল একটি গ্রাম ফুটবলের নগরী কুড়িগ্রাম’ স্লোগানে নিজ উদ্যোগে ২০১৩ সালে কুড়িগ্রাম ফুটবল প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ফুটবল বিপ্লবী জালাল হোসেন লাইজু।

অর্থ আর নিজস্ব জায়গা না থাকায় মজিদা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের একটি কক্ষে অস্থায়ীভাবে বর্তমানে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই স্কুলে খেলতে আসা কিশোর-যুবকরা বই, খাতা-কলমসহ পড়ালেখার খরচও পাচ্ছেন। এমন নানা সহযোগিতার কারণে বাড়ছে খেলোয়াড় তথা শিক্ষার্থীর সংখ্যা।

প্রতিদিন বিকেলে কলেজ মাঠে চলে প্রশিক্ষণার্থীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অতিদরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহযোহিতা করার পাশাপাশি পড়াশোনার খরচ বহন করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের জার্সি, বুটসহ খেলার সরঞ্জামাদিও দেয়া হয়ে থাকে বিনামূল্যে। ভবিষ্যতে ধরলা নদীর পারে নিজ জমিতে স্কুল স্থানান্তর করে আবাসিক/অনাবাসিক ব্যবস্থা করে জেলার গ্রাম থেকে মেধাবী ফুটবলারের খোঁজ করা এবং জাতীয় দলে উন্নত মানের খেলোয়াড় পাঠিয়ে দারিদ্রপীড়িত উত্তরের এই জনপদকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করছেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জালাল হোসেন লাইজু একাধারে ক্রীড়ালেখক, গবেষক ও প্রশিক্ষক। শহরের দাদামোড় এলাকার চল্লিশ দশকের মাঠ কাপানো খেলোয়াড় এবং রাজনীতিবিদ মরহুম পনির উদ্দিনের ছেলে। ছিলেন আশির দশকে জেলা টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন। কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময় ভলিবল ও ফুটবল খেলে সাফল্য দেখিয়েছে এই খেলাপ্রেমী ব্যক্তি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করে পাড়ি জমান ঢাকায়। এক সময় পোশাক কারখানার বড় কর্মকর্তার পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মরত অবস্থায় ক্রীড়া জগৎসহ বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে পরিচিয় ঘটে দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকের সাথে। ফুটবল সাপোটার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন অনেক দিন। এক পর্যায়ে ঘরের টানে ছুটে চলেন নিজ মাতৃভূমিতে। এলাকার ক্রীড়াঙ্গণে কিছু অবদান রাখার পরিকল্পনা নেন।

ঝিমিয়ে পড়া ফুটবলকে চাঙ্গা করতে চালু করেন কুড়িগ্রাম ফুটবল প্রশিক্ষণ স্কুল নামে। এই স্কুলের মাধ্যমে ফুটবল প্রশিক্ষণ চলছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং ইউনিয়নের বিভিন্ন বয়সের প্রায় সহস্রাধিক খেলোয়াড় আছে এই স্কুলে। শতাধিক খেলোয়াড় প্রতিদিন নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কলেজ মাঠে। এই স্কুলের অধীনে স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়মিত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন তুহিন, মাহিন, নোমি নোমান এবং মাঝে মধ্যে জাতীয় প্রশিক্ষক স্বপন দাষ, আশিষ ইকবাল রাব্বিও প্রশিক্ষণ দেন।

ইতোমধ্যে এ স্কুল থেকে ৬ জন খেলোয়াড় বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২০১৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি ২০১৮ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে হয়েছে সর্বোচ্চ গোলদাতা খেলোয়াড় উপাধিও লাভ করে এই স্কুলের প্রশিক্ষণার্থীরা। এছাড়াও বসুন্ধরা কিংস ক্লাবেও খেলার সুযোগ পেয়েছে এখানকার খেলোয়াড়রা।
sportsmail24
স্কুলের প্রশিক্ষণার্থী হৃদয় জানান, আমি রংপুর বিভাগে সর্বোচ্চ গোলদাতা খেলোয়াড় হই। পরবর্তিতে রংপুর বিভাগের হয়ে ঢাকায় খেলতে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। আমি এই স্কুলে বিনাপয়সায় প্রশিক্ষণ পেয়ে আজ এতদূর এসেছি। ভবিষ্যতে আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই।

ক্ষুদে খেলোয়াড় সাব্বির জানান, এক সময় অভাবের কারণে আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরে লাইজু স্যার আমাকে নিয়ে এসে পড়ালেখার খরচসহ পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা করেন। এতে আমি লেখাপড়ার সাথে খেলোয়াড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।

গ্রামীণ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ফুটবলের প্রতি জেলার ঐতিহ্য এবং দেশের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে লাইজুর এই স্কুলটি বড় ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে এই জেলার খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করবে।

কুড়িগ্রাম ফুটবল প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রশিক্ষক তুহিন প্রতিদিন শতাধিক শিক্ষার্থীদের ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেন। দীর্ঘদিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে প্রশিক্ষকের কাজ করছেন তিনি। তবে সরঞ্জামাদী কম থাকায় কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয় বলে জানান। একই সঙ্গে সরকার বা বৃত্তবানরা সহযোগিতা করলে দেশের বাইরেও খোলোয়াড় পাঠানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি।

কুড়িগ্রাম ফুটবল প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জালাল হোসেন লাইজু জানান, সমাজে শিশুশ্রম বন্ধ, মাদক মুক্ত সমাজ, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মুক্ত সমাজ এবং ঝড়ে পড়া শিশুসহ হরিজন সম্প্রাদায়ের শিশু/কিশোরদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ার এবং দেশের ফুটবল খেলার মান উন্নয়ন করার লক্ষেই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি। স্বপ্ন দেখি এক সময় কুড়িগ্রাম জেলা হবে ফুটবল খেলোয়াড় তৈরির কারখানা।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ধরলা নদীর তীরবর্তি ১০/২০ বিঘা জমি ক্রয় করে আবাসিক/অনাবাসিক স্কুল নির্মাণ করবো। এখানে জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেধাবীদের খুঁজে এনে খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

তিনি আরও বলেন, খেলোয়াড়দের শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা প্রদানে ইমরুলস গোলের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ইমরুলস গোল করা হলে খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করার পাশাপাশি মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু জানান, জালাল হোসেন লাইজু একজন খেলাপ্রেমী মানুষ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জেলার ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করছেন। তার স্কুলটির সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে দারিদ্রতম জেলা খেলায় এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দারিদ্রতা দূর করা সম্ভব হবে।

নাজমুল হোসাইন/কুড়িগ্রাম


বিষয়ঃ

শেয়ার করুন :


আরও পড়ুন

নড়াইলে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা

নড়াইলে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা

নড়াইলে ঘুড়ি উৎসব

নড়াইলে ঘুড়ি উৎসব

ক্রীড়ায় বিশ্ব সম্প্রীতি, বাংলাদেশের অগ্রগতি

ক্রীড়ায় বিশ্ব সম্প্রীতি, বাংলাদেশের অগ্রগতি

বিশ্বকাপের আগে এলাকার উন্নয়ন কাজে মাশরাফির দৌড়ঝাঁপ

বিশ্বকাপের আগে এলাকার উন্নয়ন কাজে মাশরাফির দৌড়ঝাঁপ