সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এ শিরোপা জয়ে সারাদেশের ন্যায় আনন্দের বন্যা বইয়ে চলছে ক্যাপ্টেন সাবিনা-মাসুরার জেলা সাতক্ষীরাতেও। সাবিনা-মাসুরাদের বরণ করতে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে দিয়েছে বাংলাদেশ নারী দল। ম্যাচে সাবিনা খাতুন গোল না পেলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন তিনি। গোল্ডেনবুট জয়ী সাবিনা ও অন্যতম খেলোয়াড় ডিফেন্ডার মাসুরাকে স্বাগত জানাতে জমকালো সংবর্ধনার আয়োজন করছে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।
চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন সাতক্ষীরা শহরের জজ কোর্টের পিছনে এক টুকরো জমি কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। পাঁচ বোনের মধ্যে সাবিনা চার নম্বর। বাকি বোনদের মধ্যে বড়জন সালমা খাতুনের বাড়িতে থাকেন। মেজ বোন হালিমা খাতুন দেশের বাহিরে থাকেন। এছাড়া সেজ বোন শিরিনা খাতুনের বিয়ে হওয়ায় স্বামীর সংসারে এবয় ছোট বোন মুন্নি একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন।
বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন ও ডিফেন্ডার মাছুরা পারভীন ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তবে ছিল অনেক প্রতিকূলতা। সেগুলোকে পিছনে ফেলে তারা এখন দেশসেরা নারী ফুটবলার। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল চ্যাম্পিয়ন গোল্ডেন গার্লস অব টিম বাংলাদেশ।
ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুনের মা মমতাজ বেগম বাংলাদেশের এমন সাফল্যে খুবই উচ্ছ্বসিত। আসরে মেয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা (৮ গোল) হওয়ায় অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করছেন তিনি। স্পোর্টসমেইল২৪.কমকে তিনি বলেন, “শুধু সাবিনা নয়, ফুটবল বাংলাদেশের সব মেয়েদের জন্য শুভ কামনা জানাই।”
সাবিনা খাতুনের বাবা সৈয়দ আলী গাজী ২০২০ সালে মারা গেছেন। পিতাহীন পরিবারে সাবিনার বড় বোন সালমা খাতুনই এখন কত্রী। সাবিনার বড় বোন সালমা খাতুন স্পোর্টসমেইল২৪.কমকে বলেন, “সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) সারাদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি জয়ের খবর কখন আসবে। অবশেষে সন্ধ্যার পরপরই টিভির পর্দায় যখন ভেসে আসলো, বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জয়ী, তখন মনে হয়েছিল স্বপ্ন সার্থক হয়েছে আমার বোনটার।”
তিনি আরও বলেন, “রাতে যখন শুনলাম, সাবিনা সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে গোল্ডেন বুট পেয়েছে, তখন চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছিলো। বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। বাংলাদেশের মধ্যে যেখানেই সাবিনা খেলতো, বাবা সেখানেই ছুটে যেত। সাবিনার আজকের এই অবস্থানের পেছনে যার সবচেয়ে বড় অবদান, সেই আকবার আলী স্যারকেও মনে পড়ছে।”
সাতক্ষীরার স্থানীয় কোচ আকবার আলী মেয়েদের বিভিন্ন ইভেন্টে কোচিং করাতেন। বছর খানেক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
সালমা খাতুন বলেন, “আমাদের ছোটবেলা কেটেছে অভাব আর দরিদ্রের সাথে। সেই সময়টা ছিল খুবই সংগ্রামের। সাবিনা এখন বড় তারকা। অন্যান্য বোনেরাও স্বাবলম্বী। সব মিলিয়ে এখন মাকে নিয়ে ভালোই আছি।”
সাতক্ষীরা সদরের বিনেরপোতায় নারী ফুটবল দলের অপর খেলোয়াড় মাসুরাদের বাড়িতেও চলছে জয়ের উৎসব। বাংলাদেশ দলের জয়ে বাবা রজব আলী শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও স্থানীয় মেলায় রাতভর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।
ডিফেন্ডার মাসুরার পিতা রজব আলী স্পোর্টসমেইল২৪.কমকে বলেন, “আমি কলারোয়া থেকে সাতক্ষীরায় এসেছি ছোটবেলায়। সংসার চালাতে কখনো চা বেচতাম, কখনো সবজি বিক্রি করতাম। এর মাঝেও মাসুরা স্কুল শেষে বাসায় না ফিরে মাঠে থাকতো। প্রথম প্রথম সাবিনাদের বল সীমানার বাইরে গেলে কুড়িয়ে আনতাম। এভাবে ফুটবলপ্রীতি তৈরি হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি এসবের কিছুই জানতাম না। যখন জানলাম, তখন বাধা দিয়েছিলাম। তবে আকবার ভাইয়ের অনুরোধে আমি আর না করতে পারিনি। শেষমেষ ফুটবলেই মেয়েটা সুনাম কুঁড়ালো।”
মাসুরার মা ফাতেমা খাতুন বলেন, “আমরা খুবই গরীব মানুষ। এমনও দিন গেছে, অনাহারে থাকতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকে মাসুরার খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখে আমি তাকে খেলা চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। কোচ আকবার আলীই আমার মেয়েকে এখন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো- এতো বড় জয় আকবার আলী দেখে যেতে পারলেন না।”
সাতক্ষীরা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আরিফ হাসান প্রিন্স জানান, নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গর্ব অনুভব করছি। বিশেষ করে সাবিনা ও মাসুরার জন্য সাতক্ষীরাবাসী গর্বিত। তারা দু’জন সাতক্ষীরায় ফিরলে স্টেডিয়ামে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জমাকালো সংবর্ধনা দেওয়া হবে, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এসএম হাবিবুল হাসান/সাতক্ষীরা