বিশাল আয়তনের দেশ ভারতে সবসময়ই শোনা যায় প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের আগমণ ধ্বনি। তরুণ প্রতিভাবানদের মধ্যে এক-দুইজন প্রতিকূলতা পেরিয়ে উঠে এলেও কালের গর্ভে হারিয়ে যান বাকিরা। হারিয়ে যাওয়াদের কেউ কেউ হয়তো থাকে সুযোগ বঞ্চিত। আবার কেউ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে না পেরে অকালেই ঝড়ে পড়ে। কেউ কেউ অমল মজুমদারের মতো বারবার ভেঙে পড়া সত্ত্বেও ভালোবাসার টানে ক্রিকেটের সাথেই গড়ে তোলে সন্ধি। তাদের মধ্যে একজন হলেন মিঠুন মানস। প্রতিভাবান এবং সামর্থ্য থাকার পরও তার গায়ে উঠেনি ভারত জাতীয় দলের বহু কাঙ্খিত সেই জার্সি।
জাতীয় দলে খেলার আগে ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিজেকে প্রমাণের জন্য রয়েছে অনেকগুলো প্রতিন্দন্দ্বীতামূলক টূর্নামেন্ট। তার মধ্যে একটি হলো রঞ্জি ট্রফি। এই টুর্নামেন্টে বছরের পর বছর রানের ফোয়ারা ফোটালে ভারতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া মুহূর্তের ব্যাপার। এই রঞ্জিতে পারফর্ম করেও ভারতীয় দলে একটিবারের জন্যও ডাক পাননি দিল্লির ক্রিকেটার মিথুন মানস।
দিল্লির হয়ে রান বন্যা তৈরি করা মিথুন মানস কিন্তু রাজধানীর ছেলে নন। ভারতের সংঘাতময় অঞ্চল জম্বু-কাশ্মীরের ছেলে মিথুন। ব্যাটে বলে তার হাতে খড়ি ওই জম্বুর মাটিতেই। তবে সেখানে ক্রিকেটের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না পেয়ে ছুটে আসেন রাজধানীতে। ১৬ বছর বয়সে রাজধানী দিল্লিতে আসা মিথুন মানসের রঞ্জি অভিষেক ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে।
দিল্লির হয়ে মিথুন মানস যখন রান করে জাতীয় দলের স্বপ্নে বিভোর ঠিক সে সময় ভারতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করে নিতে লড়াই চালাচ্ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষণ, রাহুল দ্রাবিড় আর সৌরভ গাঙ্গুলিরা। আর বাইরে অপেক্ষমান ছিলেন মুম্বাইয়ের ছেলে অমল মজুমদার। টেন্ডুলকার, লক্ষণ, দ্রাবিড়, সৌরভরা পৌঁছাতে পেরেছিলেন তাদের লক্ষ্যে। এতেই কপাল পোড়ে অমল মজুমদার-মিথুন মানসদের।
শচীন-সৌরভরা জানতেন তারা খারাপ খেললেই বাদ পড়বেন। কারণ দলের বাইরে অপেক্ষায় আছেন অপেক্ষায় আছেন তরুণ সব ক্রিকেটাররা। তাই তো প্রতিম্যাচেই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে মাঠে নামতেন। আর এতেই কপাল পোড়ে অমল মজুমদার আর মিথুন মানসদের মতো রঞ্জি তারাদের। যাদের কিনা জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠ মাতানোর সকল ধরনের সক্ষমতাই ছিল। শচীন-সৌরভরা খারাপ খেলে দলে থেকে বাদ পড়েননি, আর জাতীয় দলে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারেননি মিথুন মানস।
জাতীয় দলে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা মিথুন দিল্লির হয়ে নিজের উইলোকে বানিয়েছিলেন রান মেশিন। তবুও যখন জাতীয় দলের দরজা খোলেনি, সেই সময় তার কাঁধে বর্তায় দিল্লির অধিনায়কত্ব ভার। অধিনায়ক হয়েই মিথুনের চ্যালেঞ্জ যেন বেড়ে যায় বহুগুণে। কারণ অধিনায়ক হওয়ার পরই দিল্লির দুই নির্ভরযোগ্য ব্যাটার বীরেন্দ্র শেবাগ এবং গৌতম গম্ভীরকে হারিয়ে ফেলেন। এই দুই ব্যাটার ভারতীয় দলে জায়গা পাকাপোক্ত করে নিলে, দিল্লির ত্রাণকর্তা হয়ে উঠেন মিথুন মানস।
দুই ওপেনারের জায়গায় রাজ্য দলকে সার্ভিস দিতে থাকেন মিথুন। এমনকি দলকে রঞ্জি শিরোপা জেতাতেও তার ছিল বড় ভূমিকা। ২০০৮ সালে দিল্লি জেতে তাদের বহু কাঙ্খিত রঞ্জি শিরোপা। এ শিরোপা জয়ে অধিনায়ক মিথুন মানস শুধু অধিনায়কত্ব নয়, ব্যাট হাতে ৫৯৮ রান তুলে শিরোপা জয়ে রেখেছিলেন ভূমিকা। এতে কিছুটা আশা জেগেছিল, হয়তো ভারতীয় দলে ডাক পেতে পারেন মিথুন। তা আর হলো কই, দিল্লির ওই গন্ডিতেই আটকে রইলেন মিথুন মানস নামক রঞ্জি কিংবদন্তি। এদিকে তার অধীনেই ভারত খুঁজে পায় এক তরুণ রত্ন। আর সেই রত্ন হলো বিরাট কোহলি।
জাতীয় দলে সুযোগ পেতে হলে ঠিক কি রকম পারফর্ম করতে হবে সেই বেঞ্চমার্ক করে দেওয়া হলে, সেই পরীক্ষাতেও হয়তো উতরে যেতে পারতেন মিথুন। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে সমানতালে পারফর্ম করেও ঘোরেনি জাতীয় দলে তার ভাগ্যের চাকা।
প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে ১৫৭ ম্যাচে করেছেন ৯৭১৪ রান। আর গড় ৪৫ দশমিক ৮২। ব্যাট হাতে ২৭ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ছিল ৪৯ হাফ সেঞ্চুরি। ভারতের সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট রঞ্জিতে তার ব্যাট থেকে এসেছিল ৮ হাজারের অধিক রান।
জাতীয় দলের জার্সিতে খেলতে না পারলেও দিল্লি তাকে দিয়েছে দু'হাত ভরে। তাই তো দিল্লিতে তাকে মানা হয় ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি হিসেবে।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ক্রিকেটের টানে ঘর ছাড়া হওয়া মিথুন মানস ২০ বছর পর ফিরে আসেন নিজ রাজ্য জম্বু-কাশ্মীরে। যেখান থেকে ক্রিকেটের শুরু সেই জম্বু-কাশ্মীরের হয়েই ক্রিকেটকে বিদায় বলতে চেয়েছিলেন মিথুন মানস। এই কারণেই ফিরেছিলেন জম্বুর মাটিতে। শেষ পর্যন্ত জম্বু-কাশ্মীরের হয়ে খেলেই ক্রিকেটকে বিদায় জানান মিথুন মানস।
পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্রিকেটার গড়ার দায়িত্ব। ২০১৮ সালে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে সহকারী কোচের ভূমিকাতেই ছিলেন। আর ২০১৯ সালে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুতেও একই ভূমিকা পালন করেছেন মিথুন মানস। জাতীয় দলে সুযোগ না পেয়েও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা কোনো দিনই কমেনি। বরং প্রতিদিনই নতুন উদ্দীপনায় শুরু করতেন। আর এ কারণে ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত ক্রিকেটকে দিতে পেরেছেন নিজের সর্বস্বটা। যদিও ক্রিকেট মিথুন মানসকে দিতে পারেনি তার যোগ্য সম্মান কিংবা প্রাপ্তি।
স্পোর্টসমেইল২৪/পিপিআর